রবিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৮

তুলসী গাছ অপার মহিমা যার, যে কারণে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি এত পবিত্র।



তুলসী গাছ অপার মহিমা যার, যে কারণে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি এত পবিত্র।





তুলসী গাছ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে গুল্মজাতীয় খর্বাকার উদ্ভিদ তুলসী গাছ অতি পবিত্র বিবেচিত। সম্ভবত একারণে তুলসী গাছ নেই এমন হিন্দুবাড়ী পাওয়া যাবে না। হিন্দুবাড়ীর তুলসী গাছগুলোর গোড়ায় ত্রিসন্ধ্যা জল ও আরতী পায় । এছাড়াও প্রতিদিনের গৃহ দেবতার পূজোয় বা ভোগে তুলসী পাতা, মঞ্জুরী ব্যবহার করা হয় । তুলসীর অতি পবিত্র বলে হিন্দু শাস্ত্রাদিতে বর্ণিত আছে “যারা প্রত্যহ তুলসীর দর্শন, স্পর্শন, ধ্যান, গুণ কীর্তন, প্রণাম, গুণশ্রবন, রোপন, জল প্রদান ও পূজা এই নয় প্রকারে তুলসীর ভজনা করেন তারা সহস্র কোটি যুগ পর্যন্ত বিষ্ণুলোকে বসতি লাভ করেন”।


হিন্দুরা প্রতিদিন তুলসী পূজায় যে সকল মন্ত্র বা শ্লোক বলে সেগুলো হল –
• তুলসীতে জলদান মন্ত্র- “ওঁ নমো গোবিন্দবল্লাভাং দেবীং ভক্ত চৈতন্যকারিনীম্ স্নাপয়ামি জগদ্ধাত্রীং বিষ্ণুভক্তি প্রদায়িনিম্ ।”
• তুলসী প্রণাম মন্ত্র- “ওঁ নমোবৃন্দায়ৈ তুলসী দেবৈ প্রিয়ায়ৈ কেশবস্য চ কৃষ্ণভক্তিপ্রদে দেবীঃ সত্যবত্যৈ নমোনমঃ ।”
• তুলসী চয়ন মন্ত্র- “নমতুলস্যমৃতনামাসি সদা ত্বং কেশব প্রিয়ে কেশবার্থে চিনোমি ত্বাং বরদা ভব শোভনে ।” (দ্বাদশী তিথিতে তুলসী চয়ন নিষিদ্ধ)
• তুলসী প্রদক্ষিণ মন্ত্র- “যানি কানি চ পাপানি ব্রহ্মহপ্যাদি কানি চ তানি তানি প্রণসান্তি প্রদক্ষিণ পদে পদে ।

বিষ্ণুবীয় সাহিত্যে তুলসী সেবন লীলা বিষয়ে এভাবে লেখা হয়েছে-

“তুলসীর ভক্তি এভাবে শুনেন মন দিয়া ।
যেরুপে কৈলেন লীলা তুলসী লইয়া এক ক্ষুদ্র ভান্ডে দিব্য মৃত্রিকা পূরিয়া ।
তুলসী দেখেন সেই ঘটে আরোপিয়া প্রভু বলে আমি তুলসীরে না দেখিলে ।
ভাল নাহি বাসোঁ যেন মত্স্য বিনে জলে ।
যবে চলে সংখ্যা নাম করিয়া গ্রহণ তুলসী লইয়া অগ্রে চলে একজন ।
পশ্চাতে চলেন প্রভু তুলসী দেখিয়া পড়য়ে আনন্দ ধারা
শ্রীঅঙ্গ বহিয়া সংখ্যা নাম লইতে যে স্থানে প্রভু বসেন ।
তথায় রাখেন তুলসীরে প্রভু পাশে তুলসীরে দেখেন জপেন সংখ্যা আন ।
এ ভক্তিযোগের তত্ত্ব কে বুঝিবে আন ।
পুনঃ সেই সংখ্যা নাম সম্পূর্ণ করিয়া । চলেন ঈশ্বর সঙ্গে তুলসী লইয়া ।“
….. চৈঃ ভাঃ অঃ ১৫৪ -১৬১

তুলসী পাতা এতই পবিত্র যে, এটি একমাত্র পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণুর পাদপদ্দ ব্যতীত অন্য কোন দেবতা বা দেবীর চরনে তুলসীপাতা অর্ঘ্য হিসাবে দেয়া যায় না । অবশ্য লক্ষ্মীদেবীর পুজোয় তুলসী পাতার প্রয়োজন হয় না । এছাড়া সকল দেবতা দেবী পূজোর ভোগে তুলসী পাতা ও মঞ্জুরী অত্যাবশ্যক । তুলসী পাতা ভিজানো জল ছটা গৃহাদি পবিত্র করনের কাজে ব্যবহার করা হয় । গভীর ধর্মীয় আঙ্গিকে হিন্দু সমাজে তুলসী গাছের এতো মহিমা প্রচার করে এবং তদানুযায়ী এর পূজন ও যত্ন করা হয় ।

এখন দেখা যাক বৈজ্ঞানিক ও প্রায়োগিক ব্যাখ্যায় তুলসীগাছ বিষয়ে কি বলা আছে –
তুলসী (Tulsi/Holy Basil/ thai Krapho) একটি Lamiaceae family এর অন্তর্গত সুগন্ধি জাতীয় উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম Ocimum sanctum (sanctum অর্থ পবিত্র স্থান) । হাজার হাজার বছর ধরে সাধারণত হিন্দু পরিবারে কৃষ্ণ ও রাধা তুলসী এই দুই প্রকারে প্রাপ্ত তুলসী হিন্দু গৃহে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়ে আসছে । এর পিছনে গভীর রয়েছে ধর্মীয়,পরিবেশগত ও বৈজ্ঞানিক কারণ ।


ধর্মীয় কারণঃ
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে তুলসীকে সীতাস্বরূপা, স্কন্দপুরাণে লক্ষীস্বরূপা, চর্কসংহিতায় বিষ্ণুর ন্যায় ভুমি, পরিবেশ ও আমাদের রক্ষাকারী বলে বিষ্ণু প্রিয়া, ঋকবেদে কল্যাণী বলা হয়েছে । স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু, তুলসীদেবীকে পবিত্রাবৃন্দা বলে আখ্যায়িত করে এর সেবা করতে বলেছেন ।


তুলশী গাছের প্রয়োজনীয়তাঃ
অপরিশীম ।

পরিবেশগত কারণঃ
সাধারণতঃ উদ্ভিদ মাত্র দিনে অক্সিজেন ও রাতে কার্বনডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে । পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে তুলসীগাছ একমাত্র উদ্ভিদ যা দিন ও রাত চব্বিশ ঘণ্টা অক্সিজেন সরবরাহ করে বায়ু বিশুদ্ধ রাখে। যেখানে অন্য যেকোন গাছ রাত্রিতে কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে তাই রাতের বেলাতে তুলসীতলায় শয়ন করাও ব্যক্তির জন্য উপকারী । এছাড়া তুলসীগাছ ভুমি ক্ষয় রোধক এবং তুলসী গাছ লাগালে মশা কীটপতঙ্গ ও সাপ থেকে দূরে রাখে ।

বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্যগত কারণঃ
তুলসীতে Eugenol অধিক পরিমাণে থাকায় তা Cox-2 Inhibitor রূপে কাজ করে বলে তা ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।
• Hypoglycemic drugs এর সাথে তুলসী খেলে তা টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগে দ্রুত গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দেয় ।
• তেজস্ক্রিয়তার ফেলে ক্ষতিগ্রস্থ কোষসমুহকে মেরামত করে ।
• চর্বিজনিত হৃদরোগে এন্টি অক্সিডেন্টের ভুমিকা পালন করে ।
• তুলসী একশেরও বেশি Phytochemicals (যেমন oleanolic acid ,beta caryophyllene ইত্যাদি) বহন করে বলে ক্যান্সার চিকিত্সায় ব্যবহৃত হয় ।
• তুলসীর অ্যালকোহলিক নির্যাস Immune system এর রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে ।
• তুলসী স্নায়ুটনিক ও স্মৃতিবর্ধক ।
• শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্নরোগ যেমন ব্রঙ্কাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ,হাঁপানি প্রভৃতি রোগের নিরাময়ক ।
• সর্দি ,কাশি, জ্বর, বমি, ডায়ারিয়া, কলেরা, কিডনির পাথর, মুখের আলসারসহ চোখের বিভিন্ন রোগে ইহা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।
• দাঁতের রোগে উপশমকারী বলে টুথপেস্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হয় ।


তুলসীর গুণাগুণ আমাদের এই উপমহাদেশে যারা আয়ুর্বেদ শাস্ত্র চর্চা করেন তাদের কাছে তুলসীর গুণাগুণকে নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই । তুলসীর সিদ্ধ পানি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় । তুলসী কেবল শরীরকে নয় বরং শরীরের সাথে এটি বাতাসকেও দূষণমুক্ত করে । তুলসী পাতার অনেক গুণ রযেছে । আয়ুর্বেদে তুলসীকে ভেষজের আখ্যা দেওয়া হয় । চলুন এই ভেষজের গুণগুলো জেনে নিই ৷
* জ্বর হলে জলের মধ্যে তুলসী পাতা, গোল মরিচ এবং মিশ্রী মিশিয়ে ভাল করে সেদ্ধ করুন ৷ অথবা তিনটে দ্রব্য মিশিয়ে বড়ি তৈরি করুন ৷ দিনের মধ্যে তিন-চার বার ঐ বড়িটা জলের সঙ্গে খান ৷ জ্বর খুব তাড়াতাড়ি সেরে যাবে ৷
* কাশি যদি না কমে সেই ক্ষেত্রে তুলসী পাতা এবং আদা পিষে মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খান । এতে উপকার পাবেন৷
* পেট খারাপ হলে তুলসীর ১০ টা পাতা সামান্য জিরের সঙ্গে পিষে ৩-৪ বার খান৷ পায়খানা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে ৷
* মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে দিনে ৪-৫ বার তুলসী পাতা চেবান ৷
* ঘা যদি দ্রুত কমাতে চান তাহলে তুলসী পাতা এবং ফিটকিরি একসঙ্গে পিষে ঘা এর স্থানে লাগান কমে যাবে ৷
* শরীরের কোন অংশ যদি পুড়ে যায় তাহলে তুলসীর রস এবং নারকেলের তেল ফেটিয়ে লাগান এতে জ্বালা কমবে৷ পোড়া জায়গাটা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে ৷ সেখানে কোন দাগ থাকবে না ৷
* ত্বকের চমক বাড়ানোর জন্য এছাড়া ত্বকের বলীরেখা এবং ব্রোনো দূর করার জন্য তুলসী পাতা পিষে মুখে লাগান ৷
* বুদ্ধি এবং স্মরণ শক্তি বাড়ানোর জন্য প্রতিদিন ৫-৭ টা তুলসী পাতা চিবান ৷
* প্রস্রাবে জ্বালা হলে তুলসী পাতার রস ২৫০ গ্রাম দুধ এবং ১৫০ গ্রাম জলের মধ্যে মিশিয়ে পান করুন ৷ উপকার পাবেন ৷
* ত্বকের সমস্যা দূর করতে তিল তেলের মধ্যে তুলসী পাতা ফেলে হালকা গরম করে ত্বকে লাগান ৷


সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আদি ঋষিরা দেব সাধনায় ধ্যানস্হ থাকতেন বলে আমরা জানি । এসব ঋষিদের ধারনা গত পদ্ধতি গুলি একটিই হলো হিন্দু পরিবার গুলো তুলসী পুজো বা তুলসী সেবা । আসলে ঐ সব আদি ঋষিরা গবেষনা করতেন, যাকে আমরা ধ্যান বলছি । সত্যি সত্যি ভাবতে অবাক লাগে আমরা যে সময়টাকে জ্ঞান বিজ্ঞানের জন্য অনগ্রসর বলি, সে সময়টায় এরা তুলসী গাছের এতো গুন আবিস্কার করে । সাধারণ মানুষ যেহেতু অতি সহজে কোন নির্দেশ মানতে রাজী হয় না, হয়তঃ সেকারণে ঐসব মনিষীরা তুলসী গাছ পরিচর্যার জন্য ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের বিষয়টি নিয়ে এসেছেন বলেই হিন্দু শাস্ত্রাদিতে বলা হয়েছে – “যারা প্রত্যহ তুলসীর দর্শন, স্পর্শন, ধ্যান, গুণ কীর্তন, প্রণাম, গুণশ্রবন, রোপন, জল প্রদান ও পূজা এই নয় প্রকারে তুলসীর ভজনা করেন তারা সহস্র কোটি যুগ পর্যন্ত বিষ্ণুলোকে বসতি লাভ করেন” ।


প্রজি কুমার রায়, এম.এ,এল.এল.বি
বীর মুক্তিযোদ্ধা
সহকারী পুলিশ কমিশনার,ডিএমপি (অবঃ)
সাবেক কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
ম্যানেজার, এক্সটার্নাল এফেয়ার্স
এসএসডি টেকনোলজি লিঃ, ঢাকা
ভাইস প্রেসিডেন্ট
বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি, মহানগর কমিটি, ঢাকা ও
নির্বাহী সদস্য, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

রেস্টুরেন্ট_HD