![]() |
মাটির ঘর |
ঘর কি শুধুমাত্রই চারটি দেওয়াল আর মাথার উপর ছাদের এক পরম পরিচিত আশ্রয়, যেখানে ঘনিষ্ঠ জনের সঙ্গে কিছু নিশ্চিন্ত সময় যাপন করা যায়? সকল ক্ষেত্রে বোধ হয় তাহা নহে।
উদাহরণ, হুগলির সুপ্রিয় সাধু খাঁ। তাঁহার একখানি ঘর ছিল। যে ঘরকে তিনি অন্তত নিজের বলিয়া ভাবিয়াছিলেন। আপনজনের সঙ্গে কিছু কাল কাটাইয়াছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কালে দেখিয়াছেন, সেই ঘর আর তাঁহার নাই। দীর্ঘ সময় মানসিক হাসপাতালে কাটাইবার পর তিনি নিজের ঘরে, নিজ পরিবারের সান্নিধ্যে ফিরিতে চাহিয়াও পারেন নাই। ঘনিষ্ঠ জনরাই তাঁহাকে ফিরিতে দেয় নাই। কিন্তু তাঁহার কাহিনি সেখানে শেষ হয় নাই। তিনি ঘরের এক নূতন অর্থ খুঁজিয়া পাইয়াছেন। বে-ঘর হইবার হাত হইতে তাঁহাকে বাঁচাইয়াছেন প্রতিবেশীরা। তাঁহারাই সুপ্রিয় বাবুর দেখভালের ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাঁহার ঘরের বন্দোবস্ত করিয়াছেন। অর্থাৎ তিনি একই সঙ্গে ঘর হারাইয়াছেন, আবার ঘর পাইয়াছেন। সেই ইট-কাঠ-পাথরের সঙ্গে তাঁহার নাড়ির যোগ নাই ঠিকই, কিন্তু তাহা আশ্রয় তো বটে। সে আশ্রয় সম্মানের, মানবিকতারও। যে সম্মান, মানবিকতাটুকু না থাকিলে কোনও ঘরের ভিত্তি মজবুত হয় না।
ভাবিয়া দেখিলে, যাহাকে সুপ্রিয় বাবু ঘর বলিতেন, তাহা আসলে প্রাত্যহিক অভ্যাস। কিন্তু যথার্থ ঘর অভ্যাস হইতে পারে না। তাহা বড়জোর মাথা গুঁজিবার অস্থায়ী আস্তানা হইবে। আস্তানার সঙ্গে ঘরের পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য, স্থায়িত্বে। আস্তানা সাময়িক, ঘর দীর্ঘকালের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। কিন্তু মাথার উপরে ছাদ থাকিলেই যেমন তাহাকে ঘর বলা চলে না, তেমনই সামান্য ত্রিপলের ছাউনির, এমনকী ছাউনিবিহীন আস্তানাও ক্ষেত্রবিশেষে ‘ঘর’ হইয়া উঠিতে পারে। ফুটপাথে বা গাছতলায় সে দৃশ্য হামেশাই দেখিতে পাওয়া যায়। যে গাছতলা অন্যদের চক্ষে রোদ, বৃষ্টি হইতে বাঁচিবার ক্ষণিকের আশ্রয়, সেই গাছতলাই কিছু মানুষের কাছে তাহার সর্বস্ব, তাহার ঘর। কেহ সেখানে সাকুল্যে দুই দণ্ডও দাঁড়াইতে চাহে না, আবার কেহ বারো মাসই টিকিয়া থাকে। সেখানে হয়তো বর্গফুটের হিসাব নাই। কিন্তু একটি জীবনচক্র আছে। আর একটি সংসার।
কবীর সুমনের ভাষায় ‘রাতের সোহাগ ভোরের লজ্জা দুপুর বেলার চড় চাপাটি’র সংসার। এই পরিপাটি ঘরকন্না, পরিচিত জনের সঙ্গ পাওয়ার টানেই তো ঘরে ফিরিবার তাগিদ অনুভব করে মানুষ। সেই ঘরের ছাদ থাকুক বা না থাকুক।
নিজের ঘরে সেই পরিচিত সঙ্গ সুপ্রিয় বাবু পান নাই। পরিবর্তে হাত ধরিয়াছেন যাঁহারা, সেই প্রতিবেশীদের কথা হয়তো তাঁহার দূর কল্পনাতেও ছিল না। এই নূতন আত্মীয়রা শুধুই তাঁহাকে আশ্রয় জোগাড় করিয়া দেন নাই, মানসিক সঙ্গীও হইয়াছেন। এ হেন নিদর্শন আধুনিক সমাজে বিরল। হয়তো হুগলির সেই পাড়াটি এখনও নগর-জীবনের স্বাদ পুরোদস্তুর পায় নাই। তাই এমন অত্যাশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী হইল। বড় শহরগুলিতে সকলেই প্রাণপণ সঙ্গদোষ বাঁচাইয়া চলিতে চায়। উৎসব উপলক্ষে এক‘সঙ্গ’ হইবার একটি রীতি অধুনা জনপ্রিয় হইয়াছে বটে, কিন্তু ঘরহারাকে আশ্রয় দেওয়া বা অনাত্মীয় রোগীর চিকিৎসার গুরুভার স্বেচ্ছায় বহন করা সেখানে বোকামি বলিয়াই বহুলপ্রচারিত। এখন, শহর যে দ্রুততায় মফস্সলকে গ্রাস করিবে, একই দ্রুততায় কমিবে বোকামির এমন উদাহরণের সংখ্যা। ঘর ক্রমশ সংকীর্ণ হইতে সংকীর্ণতর হইবে।
![]() |
Photo: Projit Kumer Roy |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন